সড়কে আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি
মো. হাদিউজ্জামান
ড. মো. হাদিউজ্জামান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয়টির অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। দেশের ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনা, সড়কের অব্যবস্থাপনা, পদ্মা সেতুর সংযোগের ফলে সড়কব্যবস্থাপনার পরিবর্তনসহ সড়ক-মহাসড়কের নানা বিষয় নিয়ে দৈনিক বাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণ: শফিকুল বারী
দৈনিক বাংলা: সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল যে থামানোই যাচ্ছে না, আপনাদের গবেষণায় এর কী কী কারণ উঠে এসেছে?
অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান: সড়ক দুর্ঘটনা কোনো দৈবচয়ন বিষয় নয়, কিন্তু আমাদের এখানে এর হারের নিত্যনৈমিত্তিকতা আসলেই বড় ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। কিন্তু আমরা দেখছি যে, আমাদের সড়কে দুর্ঘটনা নিয়মিত হচ্ছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো সড়কে আগের ব্ল্যাক স্পটগুলোর সঙ্গে নতুন ব্ল্যাক স্পট যুক্ত হচ্ছে। দুর্ঘটনার পিছনে অনেক কারণ আছে। এর প্রধান প্রধান নিয়ামকের মধ্যে আনফিট ভেহিক্যাল একটি মেইন ফ্যাক্টর। ২০২১ সালের প্রথম থেকে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আনফিট ভেহিক্যাল নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো। কিন্তু ২০২১ এর শেষ নাগাদ যানবাহনের বিদ্যমান বহরের সঙ্গে প্রায় ৬০ হাজার আনফিট ভেহিক্যাল যুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি, অবৈধ যানবাহন এবং অবৈধ চালকের বাড়বাড়ন্তি ঝুঁকিগুলোকে আরও বৃদ্ধি করে দিয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও নছিমন, করিমন, ভটভটি না বন্ধ হয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক গত ১০ বছরে ক্যানসারের সেলের মতো ৪০ থেকে ৫০ লাখ সংখ্যায় আমাদের সড়ক-মহাসড়কে ছড়িয়ে পড়েছে। এসবের চালকদের অধিকাংশেরই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। এর সঙ্গে মোটরসাইকেলের বেপোরায়া যাতায়াত অবস্থাকে আরও সংকটময় করে তুলেছে। আমাদের এখানে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা এখন প্রায় ৩৫ লাখ। এদের চালকদের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশেরই ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। তাদেরকে ‘ভুতুড়ে চালক’ হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়। এদের মধ্যে একটি বড় অংশেরই বয়স ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সড়কের নিয়ম-কানুন মানেন না এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম পরিধান করেন না। তাদের মধ্যে সড়ককে ‘রেসিং ট্রাক’ বানানোর ভয়াবহ প্রবণতা দেখা যায়। এ ভাবে সড়কে দুর্ঘটনার পুরোনো কারণগুলোর সঙ্গে নতুন নতুন নিয়ামক যুক্ত হয়ে পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলছে।
দৈনিক বাংলা: এখানে যেসব ব্ল্যাকস্পটের কথা আপনি আলোচনা করেছেন, সেগুলোর মধ্যে সড়ক নির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তির অভাব বা অবৈজ্ঞানিকতার দায় কি আছে?
অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান: এখানে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে শুধু কারিগরি দিকটি প্রাধান্য দেয়া হয়, কিন্তু তার ফলে যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে, সেটিকে প্রায়ই উপেক্ষা করে থাকি।
দৈনিক বাংলা: এসব সামাজিক বিভাজনের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে কি আলোচনা করা যায়?
অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান: মহাসড়কের ফলে একটা এম্বাংকমেন্টর তৈরি হচ্ছে এবং একসঙ্গে থাকা মানুষগুলোকে সোশ্যালি আলাদা ডিভাইড করে ফেলছি। কিন্তু আত্মিক সম্পর্কের ফলে মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে সড়ক-মহাসড়কের একপাশ থেকে আরেক পাশে যাতায়াত করবেই। আরেক দিকে, সাইন্টিফিক্যালি মহাসড়ক তৈরি করছি, অবকাঠামোগতভাবে কী পরিমাণ ট্রাফিক আসবে সেটা বিবেচনায় নিচ্ছি। কিন্তু সড়কের দুই পাশে লেন ইউজ প্লেনও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ন্যূনতম বিবেচনায় আনতে পারছি না। সড়ক-মহাসড়ক পরিবহন আইনে বলা আছে, ১০ মিটারের মধ্যে কোনো স্থাপনা থাকা যাবে না। কিন্তু যখনই একটি মহাসড়ক তৈরি হচ্ছে, তখন সামাজিক বিভাজন সৃষ্টির পাশাপাশি অবৈধ হাট-বাজার থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবই গড়ে উঠছে। এর কারণে ডিমান্ড জেনারেটের মাধ্যমে পথচারী এবং হালকা যানবাহনগুলোর চলাচল অব্যাহত থাকছে। এসব হালকা যানবাহনগুলোর অনেকটাই আবার মেয়াদোত্তীর্ণ বা আনফিট কিংবা মহাসড়কে চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এই কারণগুলো দুর্ঘটনা সৃষ্টি করছে।
সড়কসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বারবার দাবি করছে যে পর্যাপ্ত ট্রাফিক লোডের সক্ষমতা ঠিক রেখে এবং মাটির গুণাগুণ সমন্বয় করে সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু আমার মতে, যেসব সংশ্লিষ্ট সংস্থা মহাসড়ক তৈরি করছে, তারাই আবার ইন্টারনেট সংযোগের কাজ করছে; আবার অন্য সংস্থা গ্রামীণ সড়কের সঙ্গে অপরিকল্পিতভাবে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করছে। এটা এক ধরনের সমন্বয়হীনতাও তৈরি করছে। আবার এর ফলে গ্রামীণ সড়কের হাল্কা যানবাহন মহাসড়কে উঠে দুর্ঘটনার কারণ হয়ে উঠছে। এখানে সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান দায়িত্ব থাকলেও আমার মতে তাদের কারিগরি সক্ষমতায় ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এখানে আমাদের যথাযথভাবে ট্রাফিক লোড, কনস্ট্রাকশন, ডিজাইনের ব্যবস্থা করা হলেও এক ধরনের পরিকল্পনাহীনতা, সমন্বয়হীনতা এবং ভূমি ব্যবস্থাপনার সঠিক নীতিমালার অভাবে সড়কের বেহাল দশা কাটছে না। এখানে মানুষকে যতই সামাজিক বিভাজনের চেষ্টা করা হোক না কেন, তারা আত্মিক সম্পর্কের তাগিদে সড়কে চলাচল করবে। তাই আমাদের অবকাঠামোগতভাবে ইনোভেশন করতে হবে। সে ক্ষেত্রেও ব্যাপক আরবানাইজেশন এবং ল্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জায়গাগুলোতে পথচারীর আনাগোনাকে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করার জন্য ফ্লাইওভার অপশন বা খুঁটির ওপর সড়ক নির্মাণেও পরিকল্পনা করতে হবে। সেখানে ইনভেস্টমেন্ট বেশি হলেও ডেভেলপমেন্টটা সাসটেইনেবল হবে। এই সড়কগুলোর কনজেশন হটস্পট বা অ্যাক্সিডেন্ট ব্ল্যাক স্পটের পরিণতি এড়াতে এই পদ্ধতির বিকল্প নেই। এ ধরনের ইনোভেশন আমাদের করতে হবে। আমরা উল্লিখিত সামাজিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় না এনে শুধু এম্বাংকমেন্টের ওপর মাটির সমতলে সড়ক বানিয়ে যাই, তাহলে সেখানে টেকসই উন্নয়ন হবে না।
দৈনিক বাংলা: আমাদের সড়ক-মহাসড়কে অনেক ব্ল্যাক স্পট রয়েছে, আবার আরিচা রোডের মতো অনেক মহাসড়কে সাইনবোর্ডহীন মৃত্যুফাঁদসম অসংখ্য বাঁক ছিল। এ ক্ষেত্রে কী এখন সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?
অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান: আমাদের এখানে সড়কে মূলত অবৈজ্ঞানিকভাবে কিছু বাঁক করা হয়েছে। যেগুলো মারাত্মক আকারের ব্ল্যাক স্পট হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। অনেকে এগুলোকে মৃত্যুফাঁদ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। এখানে এখন আরিচা রোডের অনেক ব্ল্যাক স্পটের মতো বাঁককে প্রশস্ত করে দুর্ঘটনার পরিমাণ কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। আমার মতে, এই প্রশস্ত করার উদ্যোগটা ঠিক আছে। তবে কিছু ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের টনিক প্রয়োগ করলে আরও কাজ দেবে। এখানে আমাদের রামলিস্ট্রিটের মতো বাঁকগুলোর শুরু এবং শেষ মাথায় ট্রাফিক গতি নিয়ন্ত্রণের কিছু অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। চালকদের বড় একটা অংশ শিক্ষিত না হওয়ার কারণে এই বাঁকগুলোর ট্রিটমেন্টে ফরগিভিং স্ট্রাকচারের ব্যবস্থাপনা করা গেলে অধিকতর কার্যকরী হবে। অর্থাৎ চালক ভুল করলে সড়কটির ডিজাইন অনুযায়ী চালককে ক্ষমা করে দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে। এ ক্ষেত্রে শুধু সাইন বা মার্কিংয়ের ব্যবস্থা করলেই হবে না। আরিচা রোডে বেশ কিছু বাঁককে আমরা এমন ট্রিটমেন্ট দেয়ায় দুর্ঘটনা কমে এসেছে। কিন্তু তার পরও এরকম অসংখ্য বাঁক কিন্তু রয়ে গেছে। এই বাঁকগুলো অধিকতর দুর্ঘটনাপ্রবণ হওয়ায় পর্যায়ক্রমে এগুলোকেই ট্রিটমেন্ট করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে ডিপার্টমেন্টের প্রকৌশলীদের একটা বড় দায়িত্ব রয়েছে। পরিস্থিতি এখানে আগের চাইতে বেশ উন্নত হয়েছে। আগে এলজিআইডির রাস্তার জমি অধিগ্রহণ না করতে পারার কারণে সেগুলো নির্মাণে অনেক ত্রুটি থাকত। কিন্তু এখন নতুন পলিসি আর ডিজাইনে জমি অধিগ্রহণ করার অপশন বৃদ্ধি পাওয়ায় সড়কের স্ট্যান্ডার্ড লেভেল অব সার্ভিস অনেক উন্নত হচ্ছে। আর আগের শুধু টেমপ্লেটভিত্তিক নকশার স্থলে ট্রাফিক ভলিউমের ওপর ডিপেন্ড করে ডিজাইন করা যাচ্ছে। কিন্তু আমার মতে, শুধু স্ট্যার্ন্ডাড ডেভেলপ করে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না। এখানে সবচেয়ে জরুরি ঝুঁকিগুলো হ্রাস করা। তাই প্রশিক্ষিত চালক দ্রুত বৃদ্ধি করা, অবৈধ এবং মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন হ্রাস করার বিকল্প নেই।
দৈনিক বাংলা: এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ক্যানসারের মতো ৫০ লক্ষাধিক নছিমন, করিমন, ভটভটিসহ আনফিট যানবাহনের সড়কে চলাচল কী গ্রহণযোগ্য? বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের ব্যাপারে নির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সেগুলোর চলাচল রোধ করা যাচ্ছে না।
অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান: সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ অনুযায়ী, এক্সপ্লিসিটলি ব্যাটারিচালিত থ্রি হুইলার, নছিমন-করিমন, ভটভটির মতো ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন মহাসড়কে চলতে পারবে না। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে আমাদের যাতায়াতের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠা এসব যানবাহনকে রাতারাতি উঠিয়ে দেয়া যাবে না। বিষয়টি হচ্ছে যে, দেখেন এই ধরনের যানবাহন রাতারাতি তৈরি হয়নি। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, এরকম পরিবহন আরও বৃদ্ধি পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এখানে অনেকের জীবিকার প্রশ্ন যেমন জড়িত, তেমনি স্বল্প খরচে এসব যানবাহন ব্যবহারের বিষয়টিও জড়িত। তাই এসব পরিবহন একেবারে তুলে না দিয়ে বিকল্প যাতায়াতের সুযোগ তৈরি করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সড়কে সার্ভিস লেন তৈরির বিকল্প নেই। আর এখন মোটরসাইকেলে বেশি দুর্ঘটনা হওয়ায় সেগুলোর যাতায়াতও সার্ভিস লেনে সীমাবদ্ধ করা প্রয়োজন।
দৈনিক বাংলা: আমাদের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় সাফল্য পদ্মা সেতু। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সংযোগ আমাদের সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পদ্মা সেতু অচিরেই সমৃদ্ধ করবে। সহজেই ধারণা করা যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে সেতুটির জন্য এই অঞ্চলকেন্দ্রিক ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট আরও বাড়বে। সে ক্ষেত্রে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সড়ক-মহাসড়কগুলোর ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট কি ধারণ করার সক্ষমতা রাখতে পারবে? আবার রাজধানী কি এ চাপ সামলানোর সক্ষমতা রাখতে পারবে?
অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান: আমার মতে, এখানে পরিকল্পনায় ঘাটতি আছে। দক্ষিণাঞ্চলের হৃৎপিণ্ড পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ে প্রকৃত পক্ষে তার দুই পাশে ফরোয়ার্ড লিংক তৈরি করে ফেলেছে। ফলে সেতু থেকে একসঙ্গে দ্রুতগতিতে যানবাহনগুলোকে রাজধানীর দিকে বা ভাঙ্গার দিকে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এখানে যে ব্যাকওয়ার্ড লিংক থাকা জরুরি ছিল, সেটার অভাব ভালোভাবেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের পরিকল্পনায় ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলের বেড়িবাঁধকে ঘিরে আব্দুল্লাহপুর থেকে ডেমরা পর্যন্ত এবং পূর্বাঞ্চলে আব্দুল্লাহপুর থেকে পূর্বাচল হয়ে ডেমরা পর্যন্ত প্রায় ৮৮ কিলোমিটারের একটি ইনার রিং রোড তৈরির প্রস্তাবনা ছিল। এটা পদ্মা সেতুর ট্রাফিকের গ্রোথ বা চাপ সামলানোর জন্য পরিকল্পনায় ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই প্রকল্পের কাজ এখনো শুরু করা যায়নি। এখানে আমরা চীনের উদাহরণ দেখতে পারি। এক সাংহাই সিটিতে তিনটি রিং রোড আছে, আবার চীনের অনেক শহরে ৫টার মতো লিংক রোড রয়েছে। এখানে রিং রোডটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে, ঢাকা পদ্মা সেতুর জন্য এই শহরকে প্রস্তুত করা যায়নি। সে জন্য দক্ষিণাঞ্চল থেকে উত্তরাঞ্চল বা উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াত ঢাকার মধ্য দিয়ে করার জন্য রাজধানীর অর্থনীতি মন্থর হয়ে যাবে। আমাদের এখানে যানবাহনের গ্রোথ অনুযায়ী, আগামী ৫ বছরে দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকায় ২০ হাজার গ্রোথ আসবে। এটা আগামীতে বেড়ে ৩০-৩৫ হাজার হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু সেখানে সড়ক নির্মাণের দীর্ঘসূত্রতা রাজধানীকে জটিলতায় ফেলার শঙ্কা তৈরি করছে। এখানে জমি অধিগ্রহণের দীর্ঘসূত্রতা এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহির অভাব এই জটিলতার জন্য প্রধানত দায়ী। আর বারবার রিভিশন হতে হতে আমাদের ব্যয়ও বহুগুণ বেড়ে যায়।
দৈনিক বাংলা: অপরদিকে কালনা সেতু সমাপ্ত হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের মহাসড়কগুলোর কি চাপ নেয়ার সক্ষমতা রয়েছে?
অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান: আমার মতে, সেই চাপ সামলানোর সক্ষমতা আমাদের এখনো গড়ে ওঠেনি। কেননা, ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে গোপালগঞ্জের ওপর দিয়ে খুলনায় যাওয়ার মহাসড়কটি এখনো দুই লেনের রয়েছে। কিন্তু কালনা সেতু বাংলাদেশের প্রথম ৬ লাইনের সেতু হওয়ায় নড়াইল থেকে গোপালগঞ্জের কানেক্টিভিটি তৈরি হবে এবং মাগুরা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরের যানবাহনগুলো গোপালগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ঢোকার চেষ্টা করবে। এর ফলে সৃষ্ট নতুন চাপ নেয়ার সক্ষমতা এই মহাসড়কের নেই। সে ক্ষেত্রে এটাকে দুটি সার্ভিস লেনসহ মোট ছয় লেনের মহাসড়কে পরিণত করার বিকল্প নেই। আবার যেহেতু এখানে মংলা বন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের বিষয়টিও রয়েছে, তাই বাণিজ্যিক গুরুত্ব অনেক বেশি রয়েছে। এই মহাসড়ক দিয়েই তখন বড় অংশের যাত্রী ভারতে যাবে। তাই সেখানে কাস্টমসের জনবলের সক্ষমতার ঘাটতিও বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা এবং দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। কেননা, পদ্মা সেতুর ফলে সারা দেশে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ৩ শতাংশ জিডিপির অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা আলোচনায় আসছে। সেটা বিবেচনায় দুটি সার্ভিস লেনসহ মোট ৬ লেনের পরিকল্পনা নেয়া এবং তা দ্রুত বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
দৈনিক বাংলা: সড়ক দুর্ঘটনার ফলে আমাদের প্রাণহানির পাশাপাশি সম্পদহানিও হচ্ছে বিপুল পরিমাণে। দুর্ঘটনা শুধু আমাদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে না সম্পদেরও হানি করছে।
অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান: বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, যা জিডিপির প্রায় আড়াই থেকে তিন শতাংশ। কেননা, সড়কে দুর্ঘটনায় অধিকাংশ জায়গাতেই কর্মক্ষম এবং উপার্জনশীল ব্যক্তিরাই নিহত হচ্ছেন। আবার দুর্ঘটনায় এই বর্গেরই অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। আবার যারা আহত হচ্ছেন, তাদের পেছনে বড় অংশের অর্থ চিকিৎসার জন্য ব্যয় করা হচ্ছে। ফলে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি আমাদের হচ্ছে।
দৈনিক বাংলা: দুর্ঘটনা রোধে সড়ক আইনকে কীভাবে সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা যায়? এ ক্ষেত্রে কীভাবে জনসচেতনতা তৈরি এবং জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা যায়?
অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান: আমাদের দেশে এখন শিক্ষার পাঠ্যপুস্তকগুলোতে বিভিন্ন পর্যায়ে সড়ক আইন বা নিরাপত্তার বিষয়ে কিছু কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আমার মূল্যায়নে এটা পর্যাপ্ত না। এ ক্ষেত্রে আমরা জাপানের উদাহরণ অনুসরণ করে শৈশব থেকে মস্তিষ্কে সড়কের নিয়মকানুন সহজবদ্ধভাবে ঢুকিয়ে দিতে পারি। এ ক্ষেত্রে এনজিওদের সম্পৃক্ত করে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সামাজিক আন্দোলন তৈরি করা যেতে পারে। এ ছাড়া আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নও জরুরি। এ ক্ষেত্রে পরিবহনের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্টেকহোল্ডারদের প্রতিবন্ধকতাকে বিবেচনায় আনতে হবে। তাদেরও যে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, সেটা তাদের অনুধাবনে আনার প্রচেষ্টা করতে হবে। আবার শুধু সচেতনতা দিয়েই চলবে না, আইনের কঠোর প্রয়োগও জরুরি। সে ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর মতো আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে, যাতে কেউ সেটা লঙ্ঘনের সাহস না পায়।
দৈনিক বাংলা: আপনাকে সময় দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
আমাদের যথাযথভাবে ট্রাফিক লোড, কনস্ট্রাকশন, ডিজাইনের ব্যবস্থা করা হলেও এক ধরনের পরিকল্পনাহীনতা, সমন্বয়হীনতা এবং ভূমিব্যবস্থাপনার সঠিক নীতিমালার অভাবে সড়কের বেহাল দশা কাটছে না। এখানে মানুষকে যতই সামাজিক বিভাজনের চেষ্টা করা হোক না কেন, তারা আত্মিক সম্পর্কের তাগিদে সড়কে চলাচল করবে। তাই আমাদের অবকাঠামোগতভাবে ইনোভেশন করতে হবে।
Visite Orginal
![]() |
সড়কে আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি |