সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না হলে প্রকল্প নিয়ে লাভ নেই মো. হাদিউজ্জামান

আমাদের দেশে তিন হাজার কিলোমিটারের বেশি রেলপথ আছে। এর প্রায় ৭০ শতাংশের ডিজাইন লাইফ (আয়ুষ্কাল) পার হয়ে গেছে। এগুলো এখন বুড়ো। এ কারণে রক্ষণাবেক্ষণ আরো জরুরি হয়ে গেছে।


রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে স্টিলের তৈরি যন্ত্রপাতি দিয়ে গড়া রেলের মান নষ্ট হয়ে গেছে। পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেশির ভাগ রেলের নিচে পাথর খুঁজে পাওয়া যায় না। মূলত পাথর রেললাইনকে জায়গামতো ধরে রাখে। যখন পাথর থাকছে না ঠিকমতো, তখন রেললাইনগুলো বিভিন্ন জায়গায় বসে যাচ্ছে।

ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে ট্রেন ধীরগতিতে চললেও লাইন বসে পড়ছে।

আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, আমাদের রেলগুলো ছোট ছোট স্প্যানে তৈরি। দুটি রেলের মধ্যে সাধারণত ফিশপ্লেট দিয়ে জোড়া দেওয়া হয়। এই ফিশপ্লেটগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ খুবই জরুরি।

আমাদের রেল ফিশপ্লেটগুলো পোড়া মবিল দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করে, যা পৃথিবীর কোথাও করা হয় না। ফিশপ্লেট ঠিক না থাকলে রেললাইন যখন বৃদ্ধি পায়, তখন সমানতালে সব জায়গায় বৃদ্ধি পায় না। এতে লাইন বেঁকে যাচ্ছে। আবার অনেক জায়গায় নাটবল্টু থাকছে না, পাথর থাকছে না, স্লিপার থাকছে না। সব মিলিয়ে পুরো রেল ঝুঁকিতে পড়ে গেছে।

সাধারণত ৫০ থেকে ৬০ বছর রেলের আয়ুষ্কাল থাকলেও অনেক রেলের বয়স ১০০ বছর পেরিয়ে গেছে। অথচ রেলের আধুনিকায়নের কথা বলা হচ্ছে, গতি বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। বিগত ১০ বছরে প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তবু রেলের সক্ষমতা বাড়ানো যাচ্ছে না। রেলের মান না ঠিক থাকলে প্রকল্প যতই নেওয়া হোক, রেলের আধুনিকায়ন করা সম্ভব নয়। করণীয় খুঁজে দেখার পাশাপাশি অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। দুটি জিনিস আগে খুঁজে বের করতে হবে; রেলের জ্যামিতিক পরিমাপ ঠিক আছে কি না, কোনো ত্রুটি আছে কি না। এটা নির্ণয় করার জন্য এখন যান পাওয়া যায়।

আমি যেটা মনে করি, রেলের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ তৈরি করতে এবং ট্রান্সএশিয়ান চুক্তি বাস্তবায়নে দেশের সব রেললাইনকে ব্রড গেজে রূপান্তর করতে হবে। রেলকে কেন্দ্র করে সরকারেরও ৩০ বছরব্যাপী একটি মহাপরিকল্পনা আছে। সেখানেও একই লক্ষ্যে আগানো হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পুরনো মিটার গেজ লাইন বদলে নতুন মিটার গেজ লাইন করা উচিত হবে না। এটা বড় ভুল হবে। রেলের এখন উচিত ডুয়াল গেজে যাওয়া। নৈতিকভাবে নতুন করে মিটার গেজ করার সুযোগ নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে একটি বড় অংশ ডুয়াল গেজ করলেও মিটার গেজ বসিয়ে ফেলা হয়েছে। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, রেলের সুদূরপ্রসারী চিন্তার ঘাটতি আছে।

যদিও বর্তমানে বেশির ভাগ রেলপথই ঝুঁকিতে আছে। তবু সব জায়গায় একসঙ্গে সংস্কার করা সম্ভব নয়। অন্তত অন্তর্বর্তীকালীন সমাধান হিসেবে কাঠের স্লিপারের পরিবর্তে কংক্রিটের স্লিপার ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে রেল বেঁকে যাওয়ার সমস্যা অনেকাংশে সমাধান হবে। আর আমরা রক্ষণাবেক্ষণে অনেক দুর্বল। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না হলে নতুন রেল বানিয়ে লাভ নেই। এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব মাথায় রেখে বড় বড় রেল একসঙ্গে জোড়া দিয়ে বসানো দরকার, যেন কোনো ফাঁকা না থাকে।

আধুনিক রেলগুলোতে আগে থেকেই টেনশন (চাপ) দেওয়া থাকে। রেলে টেনশন দেওয়া মানে আগে থেকেই ভেতরে টান দেওয়া আছে। ফলে গরমে আর নতুন করে সম্প্রসারিত হয় না, ওগুলো বেঁকে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। রেলগুলো বেঁকে যায় তখন যখন এর ভেতরে কমপ্রেশন ডেভেলপ করে। আগে থেকে প্রসারিত করা থাকলে পরে কিছুটা সংকুচিত হলেও সেটি আর বেঁকে যাবে না। যেমন, আমাদের মেট্রো রেলের লাইনে কোনো ফাঁকা নেই। পুরোটিই একটি ধারাবাহিক রেল। এই রেল যদি কংক্রিটের স্লিপারের ওপর বসাই তাহলে বেঁকে যাওয়ার সুযোগ নেই।

আমাদের রেল এখনো চলছে সনাতনি পদ্ধতিতে। আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করার কথা শুধু মুখেই বলি। রেলের সাংকেতিক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণ সবইসনাতনি পদ্ধতিতে চলছে। এখনো খালি চোখে দেখে রেল ঠিক করার কাজ করা হয়। রেল রক্ষণাবেক্ষণের আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের নেই। রেলের ওয়ার্কশপগুলো বেহাল হয়ে আছে। জনবলের ঘাটতি তো আছেই, পাশাপাশি যাঁরা কাজ করছেন তাঁরাও দক্ষ নন। এই সব বিষয়ই একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত। সব পক্ষের উন্নতি না হলে শুধু প্রকল্প নিয়ে রেলের সার্বিক উন্নতি হবে না।    

লেখক : সাবেক পরিচালক, এআরআই, বুয়েট


Thanks for reading this post. If you have any recommendations Please tell it in comment section 🖤